মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০০৯

ইরানে ক্যালিগ্রাফি শিল্প


ইরানে ক্যালিগ্রাফি শিল্প
-মোহাম্মদ আবদুর রহীম
১৭তম আন-র্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ইরানের রাজধানী তেহরানে গিয়েছিলাম। সেখানে ক্যালিগ্রাফির একটি জমকালো বিভাগ ছিল, যা প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ হিসেবে দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। এতে বাংলাদেশ, পাকিস-ান, কাতার, উজবেকিস-ান, আজারবাইজান, রাশিয়া, সুদান, তিউনেসিয়া, তুরস্ক, ইরাক, লেবানন, সিরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে প্রায় ত্রিশ জনের মত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। প্রদর্শনী বিকেল চারটা থেকে রাত বারোটা। সকালের দিকে আমাদেরকে বিভিন্ন ঐতিহাসিক এবং দর্শনীয় স'ান দেখানো হয়। তেহরান আল বুর্জ পর্বতমালার পাদদেশে বিশাল আয়তনের এক শহর, যাকে বলে মেগাসিটি। শহরের নতুন অংশ আধুনিক আর পুরান অংশ অত্যন- ঘনবসতিপূর্ণ। রাস-াগুলো ঝকঝকে, ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হয়, রাস-ার পাশে কিছু দূর পর পর সাদকার বাক্স আছে এবং চমৎকার ছোট পাইপাকৃতির ডাস্টবিন আছে যাতে টুকরো কাগজ কিংবা চকলেটের মোড়ক ফেলা যায়, এটা উন্নত দেশের একটা স্বাভাবিক চিত্র।
একটু নির্জন ফুটপাথের দেয়াল ঘেষে শস্যদানা ছড়ানো, কোথাও এর সাথে পানির পাত্রও রাখা আছে। বুনো কবুতর, ঘুঘু, চড়াই সেখানে একসাথে নির্ভয়ে খাচ্ছে। আর আছে নানা রকম ফোয়ারা এবং স্বচ্ছ পানির নালা। গরমের সময় প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠে। রাস-ার পাশে সারবাধা ঝাউ কিংবা চিনার গাছ। কয়েক জায়গায় দুপাশে রাস-া, মাঝে অনেক লম্বা পার্ক। পার্কের মাঝ বরাবর স্বচ্ছ পানির নালা। গাছের ছায়ায় বেঞ্চ। পানির কলকল শব্দে হৃদয় জুড়িয়ে আসে। তেহরানে গুলিস-ান প্যালেসের অদূরে বুযুর্গ বাজার অর্থাৎ বড় বাজার, এত বড় যে এক প্রান- থেকে অন্য প্রানে- যেতে লোকজন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ছে। প্রায় কিছু দূর পর পর ঐতিহ্যবাহী কারুকাজ খচিত মাজার বা মসজিদ, এমনকি কোন কোন আধুনিক ইমারতগাত্রে চমৎকার ক্যালিগ্রাফি দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে। ফ্লাইওয়ের নিচে ফাঁকা জায়গায় ফারসি অনুবাদসহ ক্যালিগ্রাফি করা হয়েছে। আছে দাস-ানে হুনারমান্দে ইরান অর্থাৎ কারুশিল্পের দোকান। ধাতু বা কাঠ দিয়ে অসাধারণ কারুকাজ খচিত জিনিসপত্র সেখানে রয়েছে, আর ইরানী কার্পেট, ওয়ালম্যাট, জায়নামাজ এত সুক্ষ্ম ও নিখুঁত দক্ষতায় বোনা, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। তেহরানেই এত রকমের জাদুঘর, যেন এন্টিক নগরী। হাজার বছরের ঐতিহ্য অত্যন- যত্নের সাথে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তেহরানের একটা মহল্লা একটা বড় শহরের মত বিশালাকায় আয়তনের। যেমন- জামারান কিংবা নিয়াভারান। জামারানে ইমাম খোমেনীর বাড়ি, অবশ্য সে বাড়িতে তিনি ভাড়া থাকতেন বলে আমাদেরকে জানানো হয়। হোটেল থেকে বহুদূর নিয়াভারান, সেখানে বিসমিল্লাহ ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলাম। এ প্রদর্শনীতে আমার শিল্পকর্ম ছিল, সেখানে আমাকে লোগো সেকশনে অ্যাওয়ার্ড প্রদান এবং জুরি বোর্ডের সদস্য মনোনীত করা হয়। প্রদর্শনীতে বিসমিল্লাহর অসাধারণ আর বিচিত্র বিন্যাসের ক্যালিগ্রাফিসমূহ দর্শকদের মুগ্ধ করে। আমাদেরকে ইফতার করানো হয় ইরানের ঐতিহ্যবাহী খাবার দিয়ে। খোমেনী মুসাল্লা অর্থাৎ খোমেনী মসজিদ কমপ্লেক্সে কুরআন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। কমপ্লেক্সের ভেতর-বাইরে অসাধারণ ক্যালিগ্রাফি আর ফ্লোরাল নকশা দিয়ে সাজানো। আন্ডারগ্রাউন্ড বাজারে ক্যালিগ্রাফি, কুরআন, তসবিহ, জায়নামাজ, হিযাব প্রভৃতির দোকান রয়েছে। প্রদর্শনীস'লে কুরআনের সিডি-ডিভিডি, বিভিন্ন রকমের অনুবাদ-তাফসির দোয়ার কিতাবসহ ধর্মীয় বই-পুস-ক রয়েছে। আলাদাভাবে সরকারি ব্যবস'াপনায় বিভিন্ন ভাষায় তরজমা-তাফসিরে সমৃদ্ধ একটি বিভাগও সেখানে ছিল। শিশুদের জন্য চমৎকার ও আকর্ষনীয় বিভাগ, ইসলামী শিল্পকলার বিভিন্ন বিভাগ যেমন- মুনাব্বাত (লতাপাতা ও এর মটিফ), যুখরুফাত (এরাবিক ডিজাইন), তাযহীব (শিল্পকলায় স্বর্নের প্রয়োগ ও ব্যবহার), নকশা ও ক্যালিগ্রাফির জমকালো শিল্পকর্মসহ সরাসরি এসব বিষয় হাতেকলমে দেখানোর জন্য শিল্পীরা বসে সেগুলো করছিলেন। ক্যালিগ্রাফির দুটো আলাদা বিভাগ ছিল, ইরানী এবং বৈদেশিক সেকশন। ইরানী সেকশনে নাস-ালিক, সিকাসে-, কুফি মাশরেকী, নাসখী ইরানী লিপির প্রাধান্য ছিল। সেখানে কাঠের ওপর ইনলে পদ্ধতিতে ক্যালিগ্রাফি ও নকশা দেখানো হয়। ধাতু পেটাই, খোদাই ও কাটাই পদ্ধতিতেও চমৎকার কারুকাজ ও ক্যালিগ্রাফি দেখানো হয়। মূলত দক্ষতা ও নিপুন হাতের ওস-াদি কত উচু স-রের হতে পারে তা এ প্রদর্শনীতে না গেলে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ক্যালিগ্রাফি শিল্পীগণ খাগের কলম দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে শিল্পকর্ম করছেন, দর্শক মুগ্ধ হয়ে দেখছে, কেউ সেটা বেশ উচ্চমূল্যে সংগ্রহ করছে। প্রদর্শনীতে আগত দর্শকদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল মহিলা ও শিশু। ইরানে হিযাব ছাড়া কোন মহিলা বাইরে চলাচল করে না। রাস-া, বাজার, অফিস, প্রদর্শনী সবখানেই হিযাব পরিহিত মহিলাদের অবাধ-অনায়াস উপসি'তি, বলা বাহুল্য, ১৫ দিনের সফরে হিযাব ছাড়া কোন মহিলা নজরে পড়েনি। প্রদর্শনীতে সংবাদ মাধ্যমের অধিকাংশ রিপোর্টার, ফটো সাংবাদিক ছিল মহিলা। ক্যালিগ্রাফি, নকশা ও শিল্পকলার সব বিভাগে মহিলাদের সরব অংশগ্রহণ ও দক্ষতা নজরে পড়েছে। ইরানী জাতি বিনির্মানে এই স্মার্ট, পরিশ্রমী, আন-রিক ও দক্ষ মহিলাদের অবদান অনুভব করা যায়। ক্যালিগ্রাফির প্রতি ইরানী শিশুদের আগ্রহ অনেক বেশী। প্রদর্শনীতে আগত শিশুরা খুব মনোযোগ দিয়ে ক্যালিগ্রাফি অঙ্কন প্রত্যক্ষ করে। শিল্পীরা তাদেরকে ছোট ছোট কাগজে ক্যালিগ্রাফি করে উপহার দেয়। অনেক শিশু চমৎকার ক্যালিগ্রাফি এঁকে শিল্পীদের হতবাক করে দেয়।
এবার রমযান মাস উপলক্ষে ইরানে বহু প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল। আন-র্জাতিক পর্যায়ে এ রকম তিনটি প্রদর্শনীতে সেখানে আমার শিল্পকর্ম মনোনীত হয়। কুরআন প্রদর্শনীতে উপস'াপিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্মের মধ্য থেকে দু’টিকে তেহরান কুরআন জাদুঘরের জন্য কর্তৃপক্ষ সংগ্রহ করে। এছাড়া আল আসমাউল হুসনা ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনীতে আমার শিল্পকর্ম স'ান পায়। ইরান ছেড়ে আসার একদিন আগে তেহরান আর্ট ব্যুরোতে গিয়েছিলাম আন-র্জাতিক ভিজ্যুয়াল আর্ট প্রদর্শনী দেখতে। বিদেশ শাখার পরিচালক আগ্রহের সাথে আমার ওয়েবসাইট দেখলেন এবং বললেন, তাদের এ প্রদর্শনীতে আমার শিল্পকর্ম নিতে খুবই আগ্রহী। হোটেল থেকে কয়েক মিনিটের পথ, আমি দুটি ক্যালিগ্রাফি শিল্পকর্ম দিলাম এবং এন্ট্রিফর্ম পূরণ করে দেয়ার পর তিনি অন্যান্য কর্মকর্তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আর ফেরার সময় প্রায় দু’শ ডলার সমমূল্যের ক্যাটালগ ও আর্টের বই উপহার দিলেন।
ইরান সফরে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির ব্যাপকতা, গুরুত্ব, ব্যবহারিক ক্ষেত্র, প্রয়োগ ও ভাবমর্যাদা বিষয়ে বৃহত্তর পরিসরে জানার সুযোগ হয়েছে। বিশেষ করে ক্যালিগ্রাফির প্রতি ইরানী শিশুদের আগ্রহ ও স্বতষ্ফুর্ত অংশগ্রহণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির বিশাল সম্ভাবনার বিষয়টিও এ সফরে সুষ্পষ্ট অনুধাবন করেছি। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির প্রসার, প্রচার ও উন্নয়নে ইরান সফর পাথেয় হয়ে থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন